বিজ্ঞানী হিমের কাফেলাটা কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম করবে, তারা পাহাড় দুটির মাঝে দারুণ পরিষ্কার একটা জায়গা পেল। চারদিকে আজব একটা নিরাবতা, দক্ষিন দিকটা প্রায় ফাকা বলে মৃদ্যু বাতাসও সেদিক থেকে বইছে। আবহাওয়া অনেকটা ভাল। কয়েক ঘন্টার মধ্যে বৃষ্টির কোন সম্ভাবনা নেই। তার সাথের আরো দুটো কাফেলা তাদের অনেক পেছনে পরেছে সেটা বুঝা যাচ্ছে। যা হোক, একটা সুগন্ধি হিমের নাকে এসে লাগছে। কি হতে পারে সেটা? ওহ হ্যা, হিমের স্ত্রী চা বানাচ্ছে। তার সাথে আরও কয়েকজন মহিলা যোগ দিয়েছে। হিম ভাবছে, চা হয়ে যাওয়ার আগ পর্জন্ত সময়টা কাটানো দরকার। মিটিং করা যেতে পারে কিংবা দেখা যেতে পারে যারা পেছনে পরেছে তারা কতটুকু পেছনে পরেছে। মানে কিছু একটা করতে হবে। তার মত বিজ্ঞানী একটা মানুষ এক সেকেন্ড সময় নষ্ট করা মানে একটা পল্লী বানের জলে ভেসে যাওয়ার মত ক্ষতি। কিন্তু এ ক্ষতিও তাদের জন্য সীমিত নয়। কারন বানের জল তাদের আগের জায়গায় সম্ভব, এখানে নয়। “তাহলে মিটিং করেই দেখি আমার মত আর কে কি চিন্তা করছেন।“- হিম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। কাফেলার পুরুষেরা একটা মিটিং-এ একত্রিত হয়েছে। হিমের কন্ঠই প্রথম শোনা গেল। কথা শুরু করার সাথে সাথেই সে যেন ছোট খাট একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেলল। সাথীরা তোমরা জান আমরা আমাদের সফরের শেষ প্রান্তে পৌছতে যাচ্ছি। এটা সেই যায়গা যেখানে আসতে আমরা সাতটি বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। আর সেই মঞ্জিল বেশী দূরে নয়। এখন আমাদের এতদিনের কষ্ট খুব তাড়তাড়ি খতম হবে বলে আমি মনে করি। এটা মনে করার কারণ খুব সহজ । আমরা নির্দেশনা মোতাবেক এগুচ্ছি, আর প্রতিটি নির্দেশনাই সত্য বলে প্রমানিত হয়েছে। এসময় সভায় বসা অবস্থায় একজন হাত তুলল। হিম সব সময় দেখেছে এ লোকটার কৌতুহল বেশি। লোকটাকে হিমের তেমন পছন্দ না, যাকে সে একান্ত তার স্ত্রীর ইচ্ছায় নিজের সাথে এনেছে। বাকি কাফেলা দুটির লোক একজন দুজন করে কম। তাদের একটাতে ঢুকিয়ে দিলেই ঝামেলা একটু কেটে যেত। লোকটার পরিচয় সে সব সময় গোপন রাখতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না । না চাইলেও সম্পর্কের নাম ধরেই তাকে ডাকতে হয়। যদিও সম্পর্কটা একটা গালি ভিন্ন কিছু নয়। সে অনেকটা বিরক্তির সঙ্গে বলল, জি শালাবাবু বলেন। বাকিরা যেন বেশ শব্দ করেই হেসে দিয়েছে।
“আমি চিন্তা করছিলাম; আমরা কি একটা শর্টকাট নিতে পারি?”- তার মধ্যে কোন ইতস্ততা বোধ নেই। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সে কথাটা বলল। হিম যেন একটু বেশিই বিরক্ত বোধ করল। এমনিতেই বেটাকে সহ্য হয় না তার পরে আবার উল্টা-পাল্টা কথা বার্তা। তাও সে কথাটার ঠিক মত জবাব দেয়ার যথা সাধ্য চেষ্টা করল।– “তুমি কি চাও আমরা নির্দেশনার বাইরে গিয়ে বিপদে পরি আর তোমার কালো বিষ্টার মত বিলুপ্ত হয়ে যাই।“– এবার অনেকে আরো শব্দ করে হেসে দিল। হিমের শালাবাবুর নাম মনিন। সে নিজের এ ধরনের মারাত্মক অপমান কিভাবে হজম করল বোঝা গেল না। যেটা বোঝা গেল, সে তার আগের জায়গায় ধপাস করে বসে পরল। হিম দাত কিড়মিড় করে উঠল। তার মিটিং-এ কেউ ধপাস করে বসে নাকি, কেউ মাছি মারার সাহস পায় না। আর এটা এমন কোন চিস? হিম বলল, “মনিন, তুমি তোমার বোনের কাছে কেন চলে যাও? তার হেল্প করো। তোমাকে আমার মিটীং-এ এতো কষ্ট করে আসতে কে বলেছে। তুমি হলে সোনার চামচ মুখে দিয়ে বড় হয়ে উঠা রাজকুমারী। তুমি কেন এখানে মাটিতে বসবে। তুমি তোমার বোনের কাছে গিয়ে বল, আপু ! চা টা সরাও আমি চুলায় বসে পরি। অন্তত একজনের খাদ্য অপচয় হওয়া কমে যাবে।” মনিন যেন এবার উঠে পরল, আরেকটু হলে কেদে দেয়। এত বড় হয়ে কাদা আবার ভারি লজ্জার ব্যাপার, দৌড়ে কোন দিকে চলে যেতে তো দোষ নেই। যা হোক হিম মাত্র ২ সেকেন্ডে মনিন শূন্য একটা সভা আবিষ্কার করল। বেটা যত দিন থেকে গলায় ঝুলেছ, ঝালিয়েই যাচ্ছে। “যেন তার জন্যে প্রেস কনফারেন্স ডেকেছি? বলদ কোথাকার।” হিম তার গলা ফাটান আবার শুরু করল।
বিজ্ঞানী হিমের স্ত্রির নাম এলা। মনিন তার বোনের কাছেই ফেরত গেছে। “আপু দেখত দুলাভাই আমাকে কিভাবে অপমান করে। তা কি যেমন-তেমন অপমান? আমার বিষ্টাকেও বাদ দেয় না। কোথায় প্রশ্নটার একটা সুন্দর জবাব দিবে তা না, আর শুধু যদি বিষ্টা বলেছে তাতেই বসে পরলাম, নবাব সাহেব আবার আমাকে রাজকুমারী বলে বিদায় দিল। আবার বলে কিনা তোমাকে বলতে যে এ চুলায় বসে পরি।” “তোমাদের এসব কোন দিনও শেষ হবে না। তুমি নিশ্চয়ই বেকুব কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছ।”– এলা বলল। “আমি তো শুধু শর্টকার্টের কথা বলেছিলাম।” “কি শর্টকার্ট!”- এলা যেন এটা বলেই হেসে দেয়। বাকিরাও যেন এলার সাথে তাল মিলাল। “তুমিও হাসছ?” “ হাসব না। এটা যদি আমার ক্ষেত্রে তুমি বলতে আমি নির্ঘাত এসে তোমাকে ঝারুপেটা করতাম। আর হিম তো মাত্র তোমাকে রাজ কুমারীর বিষ্টা বলেছে।” “কি! তোমরা দুজনেই এক রকম। আমি তাহলে শর্টকার্টেই যাব, প্রমান করব আমিই সঠিক।” এলা যেন রেগে গেল। কয়েকদিন ধরেই সে একটু তারাতারি রেগে যায়। আজও তাই হল। সে মনিনকে ধমক দিয়ে বলল, “চুপ-চাপ (একটা উচু জায়গা দেখিয়ে) ঐ উচু জায়গায় গিয়ে বসে থাক। না হলে তোমাকে রাজকুমারী্র বিষ্টার ভর্তা বানিয়ে ছাড়ব। মনিনের আর কিছু করার নেই। তার বয়স মাত্র ১২ বলেই সবাই তার সাথে এমন করে। সমস্যা কি? বয়স আর কি ব্যাপার। কাল থেকেই তাকে শেপ করা শুরু করতে হবে। এতে অন্তত হিমের চেয়ে বড় দাড়ি গোফ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। মনিন সে উচু জায়গাটায় গিয়েই বসেছে। তার তীক্ষ দৃষ্টি অন্যান্য মানুষ গুলোর উপর আছে। তার মত ছোট এখানে কেউ নেই। সে শুধু একলা। অন্য কাফেলাগুলোতেও তার মত ছোট কেউ নেই। তার পরে যে একটা সবচেয়ে বয়সে ছোট আছে তার বয়সও ১৯ বছর। “না এটা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না।” একজন তো থাকার প্রয়োজন ছিল যে তাকে অন্তত বুঝতে পারত। তার কথায় রাজকুমারির ভাজি না ভর্তা না বলে অন্তত না বলে তাকে সামান্য সম্মান দিবে। এমন সময় যেন কিছু একটা শুরু হল। সে চোখের সামনে বিভিন্ন রঙের আলো দেখতে শুরু করল। তার চারদিকের পরিবেশে যেন এক অন্ধকার নেমে এল, এত অন্ধকার যে কেউ আজ পর্যন্ত কেউ দেখেনি, সে অন্ধকারে সে যেন পরে যাচ্ছে, তখন সে চিৎকার দিয়ে ওঠে, অনেক জোড়ে, আরো জোড়ে। কিন্তু কোন আওয়াজ শোনা যায় না। হঠাৎ একটা বিজলীর আলো ঝলকানি দিয়ে উঠে। মনিন যেন অন্ধের মত হয়ে গেল। সে কিছু দেখছে না কেন?
এলা কেদে কেদে বলল, “আমি একটু আগেই তাকে ঐ উচু টীলাতে তাকে বসতে বলেছিলাম।” “তারপর?”- হিম জিজ্ঞাস করল। “তারপর পলক পরতেই দেখি সে নেই।” “নেই মানে?” “এই সবাই দেখ তো কানচোরা কোথায় গেল।”- সবাই অনেকক্ষন খোজাখুজি করল। কিন্তু কোথাও কোন চিহ্ন নেই। এলা বলল, “সে আমাকে বলছিল সে নাকি শর্টকার্ট দিয়ে যাবে।” “হায় রে বলদ খোদা। আমি আমার জীবিনে এত বলদ ছেলে কখনও দেখিনি।” “এখন তবে কি করবে?” “কি আর করব, এখানেই অপেক্ষা করতে হবে কিছু সময়। অন্তত তোমার বলদ ভাই যে পথ দিয়ে গেছে সে পথ দিয়ে ফিরে আসতে পারলেই বাচি।” এলা একটু কাদা থামিয়ে বলল, “পাহাড়ের ওপাশে চলে গেছে কিনা।” “তুমি চুপ চাপ বসে থাক আমি খুজাখুজির ব্যবস্থা করছি। এমন সময় বাকি দুই কাফেলা এসে পৌছল। এলার কান্নাকাটি দেখে সেখানে থেকে অনেকেই কৌতুহলী হয়ে হিমের কাছে আসল।
Comments (0)
See all