আগের ছয়দিন বৃষ্টি হয়েছে, আজকেউ যে বৃষ্টি থেমে গেছে তা নয়; গুড়ি গুড়ি পরছে। মনে হয় থেমে যাবে। এদিকে হেদারউদ্দিন প্রায় বিপদে আছে, তাকে এই আবহাওয়ায় তার বউকে হাস্পাতালে নিতে হবে। তার বউ রমিজা নয় মাসের প্রেগনেন্ট, একটু আগেই অবশ্য পানি বেড়িয়ে গেছে। সালটা ১৯৮৯ আর তখন একটা হাস্পাতাল বাড়ি থেকে অনেক দূরে। তার বাবা সামসুদ্দিন অবশ্য তাকে বলল একটু অপেক্ষা করতে। তার নিজের বানানো এই বাড়িতে অবশ্য এখনো কোন নাতি-নাতনির জন্ম হয়নি, সে চায় অন্তত প্রথম জনের শ্বাস-প্রশ্বাস এখানে চলুক। সে বেশ গর্বের সাথেই বলল, “হাস্পাতালে নিতে হবে কেন?” কিছুক্ষন পরেই এলাকার দাইমা হামিদা খাতুন মুখটাতে পান পুড়ে এল। তখন মেয়েদের পুরো নাম রাখা হত না, বিয়ের সময় ডাক নামের সাথে খাতুন কিংবা বেগম লাগিয়ে দেয়া হত। হেদারের মা জোবেদা খাতুন, হামিদাকে নিয়েই রমিজার কাছে গেল। তখন অবশ্য এলাকায় নতুন কারেন্ট এসেছে, তাও সংখ্যায় একশ বাড়ির মধ্যে মাত্র একবাড়িতে এর ব্যবস্থা, আর হেদারের বাড়ি সেই এক বাড়ি। হেদারের ঘরে সে নাথের উপর ফ্যানটা ঘুরছিল সেটা তার শ্বশুর আব্দুল হাইয়ের যৌতুকের টাকায় কেনা। হামিদা ঘরে ফ্যান পেয়ে বেশ কিছুক্ষন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল, তারপর রমিজার পেটে হাত দিয়ে বাচ্চার অবস্থা দেখল। রমিজার যত সময় যাচ্ছিল ততই যন্ত্রনায় আরো বেশি অবশ হচ্ছিল, একবার সে অজ্ঞান হয়ে যায়, যখনুঠে সে জানতে পারে তার সন্তান নাকি তার পেটেই মারা গেছে। তাকে অবশ্য পরে হাস্পাতালে নেয়া হয়েছিল, এলাকার একটা ভেজা ঠেলাগাড়ি দিয়ে। ডাক্তার বলেছিল বাচ্চাটা নাকি পেটে বেশি বড় হয়ে গিয়েছিল। রমিজা এর পর ২ মাস বিছানা থেকে ঊঠতে পারে নি। দ্বিতীয় সন্তানকে ভালমত জন্ম দেয়ার জন্য হেদারই সিদ্ধান্ত নিল রমিজার সি-সেকশন করা হবে। ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে বাচ্চা জন্মের কয়েকদিন আগেই তাকে হাস্পাতালে নিয়ে যাওয়া হল। রমিজার এটা ভাল লাগল যে তাকে অজ্ঞান করে খুব সহজে তার পেট থেকে বাচ্চাটাকে বের করা হবে, আর সে কোন টের পাবে না। তখন অবশ্য দেশের অবস্থা মুটামুটি খারাপ ছিল, বিরোধী দলের দুদিন পর পর হরতাল লেগে থাকত। এরকম হরতালের একটি দিনে মাগরিবের নামাজের সময় রমিজার দ্বিতীয় সন্তান প্রথম হয়ে এ পৃথিবীতে শ্বাস গ্রহন করল।
রমিজার সাথে অবশ্য তার মা নূরজাহান ছিল, তার বাবা অপারেশনের দিন কোন গাড়ি ঘোড়া না থাকায় হেটেই চলে গিয়েছিল ঢাকা মেট্টপলিটন হাস্পাতালে। হেদারঊদ্দিন অবশ্য উকিল সে তার যৌতুকে পাউয়া মোটর সাইকেল দিয়ে আদালতের কাজ শেষ করেই হাস্পাতালে গিয়েছিল সেদিন। হেদারউদ্দিনের আছে বলছে, তিন ভাই; ২য়টি সালাম, বেলায়েত চিন নম্বর, আর হাইজুদ্দি সবার ছোট। অপ্রর দিকে রমজারও ২ ভাই ছোট, কালাম বড়টা আর ছোটটা আসাদ। হেদার যখন রমিজাকে বিয়ে করে তখন রমিজার বয়স ১৭, আর তার বয়স সাতাশ। তবে রমিজা এটা অবশ্য নিশ্চিত না তার বয়স আসলেও সতের কিনা, তার বাবা অবশ্য কাবিনে তার জামাইওয়ের সাথে মিল রেখে জন্ম তারিখও দিয়েছিল ৩১ শে ডিসেম্বর। হেদার তার প্রথম ছেলের নাম রাখল শোহাগ। তার চিন্তায় এটা ছিল হয়তো সে তার ছেলের নাম রাখবে আশিক কিংবা শোহাগ। হেদারের এখনো মনে আছে তার আরো দুটি ভাইয়ের কথা, একজন নিউমোনিয়ায় মারা গেছে আর অন্য জন যখন বেশ ছোট ছিল, সে ঘুমিয়েছিল হেদার সেটা খেয়াল করেনি। লাফ দিয়ে সে তার উপরেই পরেছিল, সম্ভবত বক্ষের হাড় ভেঙ্গে মারা গিয়েছিল। তার ইচ্ছা আছে আরেকটা মেয়ে নেয়ার, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে, কিংবা দুটা ছেলে আর একটা মেয়ে। কিন্তু এখন না, তাকে আরো বড়লোক হতে হবে, মানুষ তাকে সম্মান দিবে, সমাজ তাকে প্রধান ভাববে। তার এখানে ছোট বেলার কথা মনে আছে একটা কবিতা পরতে না পারায় বাংলা এক পান খাওয়া টিচার কি মারটাই না দিয়েছিল। অন্যদের তখন টিচারকে বলতে হয়েছে তাকে যেন না মারে। সোহাগের ৯ মাস হওয়ার পপ্রেই অন্য একটা সমাজে এসে পরল, দক্ষিন গজারিয়া পাড়া, আমিরুদ্দী মৌলভীর এলাকা। এখানে সামসুদ্দিন তার ছেলের জন্য বেশ বড় জায়গা রাখে, মাটির একটা খুব ভাল ঘর করে দেয় টিনের চাল দিয়ে।
সোহাগের অবশ্য আগামী পাচ বছরের তেমন কিছু মনে থাকবে না, শুধু তাই মনে থাকবে যা তার মনে অনেক বড় দাগ কাটবে কিংবা তার মা তাকে বলবে, কিংবা নানীর কাছে শুনবে। গল্প কোন ভাবে সোহাগের অনেক প্রিয় হয়ে ঊঠবে, সে তখন থেকেই তার নানীর দেখা পেলে বলবে, নানী একটা গল্প শোনাও। সোহাগ পরবর্তীতে নিজেও এরকম অনেক গল্প তৈরি করবে আর গল্পের খোজ করবে। হেদারউদ্দিন যখন এলাকাটিতে প্রথম আসে তখন এটা এত উন্নত ছিল না। মসজিদও ছিল একটা চালের মসজিদ আর একটা বড় পুকুরের পাড়ে, পুকুর বললে ভুল হবে, বলা যায় খাদ, ইমাম মুটামুটি কএকটা কথা বলেই জুমুয়ার নামাজ পড়াত। এলাকার পছন্দনীয় হয়ার জন্য সে ভালোই সমাজে টাকা দান করত, তার মনে হত সে ছাড়া আর কে জান্নাতে যেতে পারবে। অথচ এ টাকার রোজগার একদিনে হয় নি। প্রথমে তার আইডিয়া ছিল না সে উকিল হবে। তার কাছে অনেক অ্পশন ছিল। তার বাবা সামসুদ্দিনের অনেক জমি, তাই জমি নিয়েও অনেক ঝামেলা ছিল। মাঝে মাঝে মারামারি হত। সামসুদ্দিন তখন হেদারের হাতে দা ধরিয়ে দিয়ে বলত, আমি সাম্নের দিকে দেখব আর তুই আমার পেছনের দিকে দেখবি কেউ কোপ দেয় নাকি। কোর্টের চক্কর কাটতে কাটতে হেদারের ইচ্ছা হলো সে উকিল হবে। কলেজ শেষ করে সে ঢাকা গেল, আগে পরিবারের ছেলেদের প্রাইভেট পরিয়ে তাদের বাসায় থাকা যেত। তাকে এভাবে থাকতে হল ২-৩ বছর। তার মনে পরত তার বাবা আগে তাকে ২ টাকা দিত স্কুলে গিয়ে খরচ করার জন্যে, ঢাকা এসে তাকে হাজারে হাজার খরচ করতে হয়। সে ল পাশ করার পরেও একশ-দেড়শর বেশি টাকা পেত না। ঘটক তখন রমিজার ছবি এনে তাকে দেখায়, তার বাবাও তাকে বলে বিয়ে করে ফেলতে। এ ছবিটা পরে রনিজা তাদের পারিবারিক এলবামে রাখবে, হালকা হলদে রমিজার ১৫ কিংবা ১৬ বছরের ছবি।
সোহাগের যখন মাত্র জন্ম হল, তখম রমিজা বেশ অসুস্থ থাকত এজন্য জরিনা নামের এক মেয়েকে রাখা হল। ছোট সোহাগের সাথে জরিনা খেলে আর দরকার হলে তাকে গোসল করায়, ক্ষিদে লাগলে তাকে মায়ের কাছে নিয়ে যায় দুধ খাওয়াতে। রমিজার মা মাঝে মাঝে হেদারের আগের বাড়িতে আসত পিঠা বানাতে, জরিনা তখন সোহাগকে নিয়ে যেত রান্না ঘরে, তার দাদি আর নানীকে একসাথে পিঠা বানাতে দেখতে। খুব বেশিদিন হয় নি যখন সোহাগের সাত মাসে জরিনা স্তন ক্যান্সারে মারা যায়। তখন এ ক্যান্সার এমনই ছিল যে কেউ কাউকে কিছু না বলেই মারা যেত।
হেদারউদ্দিন তার বিয়ের সময় যে মটর সাইকেল পেয়েছিল, সেটা শিখেছিল মাত্র দুই দিনে, হয়তো এজন্যই তার ছেলের প্রতিও কোন ভাবে তার এধরনের বিশ্বাস হয়েছিল। মটরসাইকেল শিখার মাত্র মাত্র কয়েকদিন পরেই এক বৃষ্টির দিনেসে রমিজাকে নিয়ে শ্বশুড়বাড়িতে রউনা হয়েছিল, মারত্মক এক ইপছলা খেয়ে দুজনেই পরে যায়। হেদারের গোড়ালীতে আজীবন সেই এক্সিডেন্টের দাগ অমর হয়ে থাকবে। তার শ্বশুড় বাড়ি অবশ্য পাবূরে, আগে কাপাসিয়া দিয়ে ঘূরে যেতে হত। রমিজা যখন বাপের বাড়ি থেকে ফেরত আসত অখন সালাম চিৎকার দিত এটা বলে, এই খালেদা জিয়া এসে গেছে।
হেদারের যখন ওকালতি দিয়ে আয় রোজগার ভালো হল তখন সে পাকা বাড়ির কাজ শুরু করল। দেখতে দেখতে একতলা হয়ে যায়ে মাটির ঘরটার ডান পাঁশে। সহাগের যখন বয়স ৫ বছর হবে তখন একদিন তাকে হাস্পাতেলে নেয়া হবে, সে হাস্পাতেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বুঝতে পারবে না তার বাবা মা তাকে একটা ভাই উপহার দিতে যাচ্ছে, তার ভাইকে যখন রমিজার কোলে দেয়া হবে তখন সে তার ভাইকে প্রথম দেখবে, একদম টিউব লাইটের মত সাদা। তখন অভিনেত্রী ডলি জহুর তার স্মামীর অপারেশইনের জন্য হাস্পাতালে এসেছিল, সোহাগের ভাইকে রুমের বাইরে থেকে দেখে সে একটু মজা করতে আসল। সে সোহাগকে উদ্দেশ্য করে বলল, সে নাকি তার ভাইকে নিয়ে যাব, সোহাগও তাকে চোর চোর বলতে লাগল। সালটা তখন ১৯৯৯, যখন প্রথম সোহাগ বুঝতে পারল কথায় মানুষকে হাসানো যায়।
সামসুদ্দীনকে সবাই “কেতা” বলে জানে। সবসময় যে তার ভাল সময় গিয়েছে তা নয়, তার ছেলে হেদারের মতে, সবচেয়ে খারাপ সময় ছিল ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে। এক রাজাকার একবার হিংসা করে তাকে ধরে নিয়েগিয়েছিল, ১০-১৫ দিন পর তাকে ক্ষেতে ফেলে দিয়ে পরে চলে যায়। ৩ মাস সে বিছানায় ছিল। সোহাগ এভাবেই এরকম কাহিনীর ভিতর বড় হবে, একসময় তার মনে হবে তার জীবন তার কাহিনীর না, অন্য সবার কাহিনীতে শুধু সে আছে।
Comments (0)
See all